‘ভারতীয় কংগ্রেস যদি শেরে বাংলার সঙ্গে অসহযোগিতা না করতো তাহলে বোধহয় উপমহাদেশের চিত্র অন্যরকম হতো’-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়



এটা সুনীল গাঙ্গুলীর বহু আগে সুভাষচন্দ্র স্বয়ং বলেছিলেন (মানে আক্ষরিক এই বাক্যটিই না, তবে অর্থে একই) এবং আমার মনে হয়, এই কথায় সত্যতা আছে।
১৯৩৫ এর ভারত শাসন আইন অনুসারে ১৯৩৭ সালে যখন নির্বাচন হয়, দেখা গেল দেশের ৪০৯ টি মুসলিম সংরক্ষিত প্রাদেশিক আসনে লীগ জয় লাভ করেছে মাত্র ১০৯ টি তে। তার মানে এই দাঁড়ালো যে জিন্নাহ সাহেব যে নিজেকে মুসলিম সমাজের, আয়েশা জালালের ভাষায় 'সোল স্পোকসম্যান' বলে দাবী করছিলেন সেটা যে ফাঁকা দাবী, তা একেবারে খাতায় কলমে প্রমাণিত হল। এখন কংগ্রেস যদি একটু খারাপ ফল করত, তাহলে হয়তো সতর্ক হত। কিন্তু এই একধার থেকে সব জিতে গিয়ে নেহেরু, সর্দার প্যাটেল, রাজাজি, রাজেন্দ্রপ্রসাদ এনারা ধরা কে সরা দেখলেন (গান্ধি বোধ হয় এত আত্মবিশ্বাস পছন্দ করেননি, তাঁর এই সময়ের লেখায় বার বার জনগণের সাথে চলার, সবসময় তাঁদের নাড়ির গতি বোঝার চেষ্টা করার নির্দেশ আছে)।এনারা সব মিলে ঠিক করলেন, যে সব প্রদেশে কংগ্রেস একক সংখ্যায় সরকার করতে পারবে - করবে। যেখানে পারবে না, অন্য কোনো দলের সাথে সমঝোতা করবে না। এখন বাংলায় কংগ্রেস বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল - ৫৪টি আসন সহ, ফজলুল হক ও তাঁর কৃষক প্রজা পার্টি 'ডাল-ভাত' এর স্লোগানে পেলেন - ৪০টি আসন আর লীগ পেল ৩৯টি আসন। হক সাহেব বার বারই ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, লীগ না, কংগ্রেসের সাথে জোট করে সরকার করার, শরৎ বসু - কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতার এতে কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু আগের নীতিতে অটল থেকে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কোনো জোট সরকারে যেতে রাজী হল না। এটা যে কি রকম গন্ড মুর্খামি হচ্ছে সেটা লিখে সুভাষচন্দ্র এ আই সি সি কে চিঠি দেন। কিছুতেই কিছু হল না। শেষে হক সাহেব লীগের সাথে সমঝোতা করে সরকার করতে বাধ্য হলেন। কৃষক প্রজা পার্টি কিন্তু একটি অসাম্প্রদায়িক দল ছিল। হিন্দু মুসলিম দুই ধর্মের লোকেরাই এই দল করতেন। বিভাজন ছিল এই ভাবে, কংগ্রেস হল পশ্চিমবঙ্গের দল, কেপিপি পূর্ব বঙ্গের - ধর্ম ধরে নয়। যখন এমনকি শ্যামাপ্রসাদ ও হিন্দু মহাসভা, লীগের ও হকের সাথে সমঝোতা করে সরকারে ঢুকে গেছেন, তখনও নৌসের আলির মতো বিদ্রোহী কেপিপি নেতারা, যারা লীগের সাথে, সাম্প্রদায়িকতার সাথে, কোনো সমঝোতা করতে চাননি, মন্ত্রী সভা থেকে বেরিয়ে এসে কংগ্রেসের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লীগের রাজনীতির বিরোধিতা করেন। এখন, যদি শেরে বাংলাকে কংগ্রেস বিজয় মদমত্ত হয়ে লীগের হাতে ঠেলে না দিত, বাংলায় লীগের কোনো প্রভাবই থাকত না কারণ বাংলায় লীগের আলাদা কোনো গ্রাম স্তর অবধি বিস্তৃত সংগঠন ছিল না, তারা কেপিপির সংগঠন গ্রাস করে নেয়। লীগের প্রভাব না থাকার অর্থ, নৌসের আলির মতো নেতারা, যারা এমনকি ৪৭ অবধিও ঐক্যবদ্ধ বাংলা ও ভারতের জন্য গলা ফাটিয়ে গেছেন, তাঁরা আরও গুরুত্ব পেতেন। এই পরিস্থিতিতে ৪৭ সালে বাংলা বিভাজিত হত না, এমন একটা সম্ভবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর কিছু হোক আর না হোক, কংগ্রেসের এই 'ঐতিহাসিক ভুল' ছাড়া, অন্তত লীগ ও জিন্নাহ বাংলার মুসলিম সমাজের কণ্ঠ বলে নিজেদের দাবি করতে পারত না। আব্দুর মন্সুর আহমেদ সঠিক ভাবেই বলেছেন - 'হক সাহেবের মতো সবল ও জনপ্রিয় নেতা কংগ্রেসের পক্ষে থাকিতেন। মুসলিম লীগে যাইতে বাধ্য হতেন না। বাংলার কৃষক প্রজারা কংগ্রেসের প্রতি আস্থাশীল হইত।' যেখানে কংগ্রেস দ্রুত বন্ধুত্ব করতে পারত, সে জায়গায় অপমানের দ্বারা তারা ফজলুল হকের মতো প্রভাবশালী নেতাকে চরম শত্রু বানিয়ে ছাড়ল। এর পরিণতি, কংগ্রেসের, হক সাহেবের এবং সামগ্রিক ভাবে বাঙালির পক্ষে চূড়ান্ত বিয়োগান্তক হয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

👉দিগন্তের প্রতি মুহুর্তের খবর পেতে ডাউনলোড করুন আমাদের মোবাইল অ্যাপস

Comments

Popular posts from this blog

কুষ্টিয়ায় উপজেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক কর্তৃক সভাপতি রক্তাক্ত

ইজরাইলি পতাকার অর্থ কি?